কিডনি জটিলতা নিরাময়ে চাই সচেতনতা
বিশ্বের ৮৫০ মিলিয়ন মানুষ দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত, যার মধ্যে প্রতিবছর ২.৪ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। বিশ্বব্যাপি প্রতি ১০ জনে ১ জন এবং বাংলাদেশে প্রতি ৭ জনে ১ জন কিডনি রোগে আক্রান্ত। দিন দিন বিভিন্ন কারণে কিডনি রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ একটু সচেতন হলেই আমরা কিডনি সুস্থ রাখতে পারি।
কিডনির মানবশরীরে রক্ত প্রবাহ পরিচালনা করে। কিডনিতে প্রায় ১০ লক্ষ নেফ্রন নামক উপাদান থাকে, যা রক্তে জমে থাকা দূষিত ও ক্ষতিকারক পদার্থ আলাদা করে প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীর থেকে বের করে দেয়। এর পাশাপাশি শরীরের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা, বিভিন্ন হরমোন তৈরি বা তৈরিতে সাহায্য করা, রক্তকনা তৈরিতে সাহায্য করা, শরীরের হাড় সুস্থ রাখা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ কাজও কিডনি দ্বারা হয়। তাই কিডনি যদি সুস্থ না থাকে তাহলে এসব কাজে বিঘ্ন সৃষ্ট হয় এবং শারীরিক বিপর্যয় দেখা দেয়।
কিডনি রোগীদের অধিকাংশই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। অনিয়ন্ত্রিত ও দীর্ঘকালীন ডায়াবেটিস কিডনি বিকলের অন্যতম কারণ। উচ্চ-রক্তচাপ আরেকটি কারণ। এটিও ডায়াবেটিসের মতোই নীরব ঘাতক। গ্লোমেরুলোনেফ্রাইটিস, পলিসিস্টিক-এর মতো কিডনি জটিলতার কারণে উচ্চ-রক্তচাপ হতে পারে। ফলে উচ্চ-রক্তচাপের কারণ খুঁজতে গিয়ে কিডনির অন্তর্নিহিত আরেকটি রোগও ধরা পড়তে পারে। অন্যদিকে, শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দিলে কিডনি বিকল হয়ে পড়তে পারে। পানিশূন্যতার অন্যতম কারণ হলো ডায়ারিয়া, বমি ইত্যাদি।
তবে অতিরিক্ত গরম, শরীর পুড়ে যাওয়া, অতিরিক্ত রক্তপাত ইত্যাদি কারণে শরীর থেকে অনেক লবণ পানি বেরিয়ে যায়। ফলে পানিশূন্যতা দেখা দেয় এবং কিডনি বিকলতার ঝুঁকি থাকে। পরিবারে কিডনি রোগের ইতিহাস থাকলেও কিডনি রোগ দেখা দিতে পারে। এছাড়া প্রস্রাবের চাপ আটকে রাখা, অপুষ্টি, ধূমপান, অতিরিক্ত বা ভুল ঔষধ খাওয়া ইত্যাদি কারণেও কিডনি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সাধারণত ৭০-৮০ ভাগ কিডনির কর্মক্ষমতা নষ্ট বা বিকল হওয়ার আগে রোগের উপসর্গ বোঝা যায় না।
তবে প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া, ঘন ঘন প্রস্রাব, প্রস্রাব লাল হওয়া, প্রস্রাবে দুর্গন্ধ, কোমরের দুই পাশে ও তলপেটে ব্যথা, শরীর-মুখ ফোলা ইত্যাদি কিডনি রোগেরই সংকেত দেয়। এসব সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। চিকিৎসার তিন মাসের মধ্যে রোগ না সারলে এটিকে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ হিসেবে ধরা হয়। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও নেফ্রাইটিসের (কিডনির বিভিন্ন সমস্যা) কারণে শতকরা ৮০ ভাগ রোগীর কিডনি বিকল হয় বা ঝুঁকি থাকে।
আমাদের দেশেই এখন কিডনি রোগের আধুনিক পদ্ধতিতে রোগ নির্ণয়, পরামর্শ এবং বিশ্বমানের চিকিৎসা সম্পন্ন হচ্ছে। সিটি স্ক্যান, এমআরআই এবং কিডনি বায়োপসি ছাড়াও আধুনিক পদ্ধতি যেমন; ইউআরই (প্রস্রাবের রুটিন পরীক্ষা); ইউরিন অ্যালবুমিন; ক্রিয়েটিনাইন রেশিও (এসিআর); ইজিএফআর; কেইউবি এরিয়ার আল্ট্রাসাউন্ড ইত্যাদি পরীক্ষার মাধ্যমে কিডনি রোগ নির্ণয় করা হয়।
কিডনি রোগের চিকিৎসা কিছুটা ব্যয়বহুল বটে, তবে একটু সচেতন হলে ৫০-৬০ ভাগ ক্ষেত্রে সেই ঝুঁকি প্রতিরোধ করা সম্ভব। পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান, বছরে একবার কিডনি পরীক্ষা, ডায়াবেটিস ও উচ্চ-রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ঔষধ না খাওয়া; অপুষ্টিকর ও ভেজাল খাবার পরিহার করা; নিয়মিত হাঁটাসহ শারীরিক পরিশ্রম করা কিডনিকে সুস্থ রাখতে ও রোগের ঝুঁকি প্রতিরোধে সাহায্য ব্যাপক করে।
কিডনির একটি জটিল রোগ হলো সিকেডি, যা অন্যান্য অবস্থার তুলনায় কিছুটা গুরুতর। তবে এক্ষেত্রে সর্বপ্রথম করণীয় হল অস্বাভাবিক জীবনযাপন ত্যাগ করা, যতটা সম্ভব সতর্ক থাকা, সময়মতো ঔষধ খাওয়া, শারীরিক-মানসিকভাবে সুস্থ থাকার চেষ্টা করা। এছাড়া, উচ্চ-রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, উচ্চ-কোলেস্টেরল ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণে রাখা। সিকেডি’র অবস্থা গুরুত্বর (স্টেজ ৫) হলে ডায়ালাইসিস অথবা কিডনি প্রতিস্থাপনেরও প্রয়োজন হতে পারে। তাই এসময় রোগীর বাড়তি যত্ন নিশ্চিত ও সচেতন থাকা খুব জরুরি।